একজন জীবন্ত কিংবদন্তি

একজন জীবন্ত কিংবদন্তি, আজ তাঁর জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে যতোই বলতে থাকবো আপনার দিক থেকে দেখবেন জানার কোন আগ্রহ ফুরাবে না। গায়ক হিসেবে তিনি "হাসান" নামে পরিচিত একজন ব্যান্ড সঙ্গীতশিল্পী। তার জন্ম ১৯৭৪ সালের ১৯ এপ্রিল রাজধানী ঢাকা শহরেই। তার মোট গানের সংখ্যা ২০০ টিরও বেশি। তিনি ১৯৯৩ সালে ব্যান্ডদল আর্কে ভোকালিস্ট হিসাবে যোগ দেন।

আর্কে থাকা অবস্থায় বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পরবর্তীতে ২০০২ সালে আর্ক ব্যান্ড ছেড়ে দিয়ে নতুন ব্যান্ড "স্বাধীনতা" গঠন করেন। ২০১০ সালের শেষের দিকে তিনি আবার আর্কে যোগ দেন। মূলত টুলু এবং পঞ্চম এর সাথে তার সঙ্গতে তিনি গানের প্রকৃত মর্যাদা অনুভব করেন।

হাসানের সঙ্গীত জীবনের উত্থান আকস্মিক। একদিন বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতাঙ্গনের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব আশিকুজ্জামান টুলুর সাথে তার পরিচয় হয়। তিনি তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে প্রস্তাব করলেন যে, বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে ইংরেজি গানের সুরে বাংলা গানের একটা কমার্শিয়াল ক্যাসেট বের করা হবে, এ জন্যে তাকে গান গাইতে হবে। হাসান প্রস্তাব মেনে নিয়ে গান গাইলেন। প্রথম এ্যালবাম কপিয়ার অতটা জনপ্রিয়তা না পেলেও দ্বিতীয় এ্যালবাম কপিয়ার-২ অপ্রত্যাশিতভাবে প্রচন্ড হিট হয়ে গেল।

১৯৯৬ আর্কের তাজমহল এ্যালবামের মাধ্যমে হাসান নতুনভাবে পাদপ্রদীপে আসেন। মূলত তার উত্থান এখান থেকেই শুরু। এই এ্যালবামে তার গাওয়া গানগুলি ছিলো নিজের লেখা এবং সুরে। এই এ্যালবামটি সুপার হিট হওয়ার পর তিনি একজন ব্যান্ড সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে পরিচিতি লাভ করলেন। এটি ছিল কিছুটা পশ্চিমা ধাঁচের গাওয়া গান। এখানে তিনি অনুসরণ করেছিলেন পশ্চিমাদের কণ্ঠ, ভাব, সুর ইত্যাদি।

আসলে এটা তখনকার বর্তমান যুগের ছেলে মেয়েদের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। আর এই কারণেই হাসান খুব অল্প সময়ে অনেক বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন। আর্কের এ্যালবাম তৈরীর প্রায় দুই বছর পর ১৯৯৮ সালে তার ব্যান্ড আর্ক জন্মভূমি নামে আর একটি ক্যাসেট বের করলো। এই এ্যালবামটিও সুপার হিট হয়। এটি তাজমহলের চেয়ে অনেক বেশি দর্শক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

২০০৪ সালে জেমস এর সাথে “বৃহস্পতি” নামে মিশ্র একটি এ্যালবাম করেন। এর পরের এ্যালবামগুলি হল আপন কষ্ট, আষাড়ে শ্রাবণ, আসমান জমিন, ইচ্ছে, ও সাথিরে, কথা দে, খেলারাম খেলেযা, চন্দ্র গ্রহণ, ছলনা, ছুটি, জগৎ বাড়ি, দহন তোমার জন্য, দেখাও দিলানা, দেনা পাওনা, নগদ বাকি, নিরবতা, পরিক্ষা, ফিরে আয়, বিচার, যে যায় ফিরে আসেনা, রঙের ঘুড়ি, সারেগামা, সাত রং এর কষ্ট, সুন্দরী, ও কন্যা, কন্যা মন দিলি না, ময়না যাইওনা সহ অনেক এ্যালবাম তিনি করেছেন।

হাসান মনে করতেন তিনি তার গানের কথায় ও সুরে পুরাপুরি সন্তষ্ট না। তার মধ্যে অনেক ভুল রয়েছে। তিনি এমন কিছু গান করতে চান যেটা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেবে, তখনই তিনি নিজেকে একজন স্বার্থক শিল্পী মনে করবেন।

হাসানের একক এ্যালবাম হচ্ছে ‘তাল’ প্রেমের তাজমহল' হ্যালো কষ্ট' ভালোবাসা মানে দুঃখ' লালবন্ধু নীলবন্ধু' তিনসত্যি' মেঘদে পানিদে' ফেররী॥

হাসান তাঁর আর্কের সাথে শেষ ভলিউম স্বাধীনতা। তারপর বের করেন একক অ্যালবাম ‘তাল’। পরবর্তী ৪ মাস আমেরিকাতে থাকার পর সেখান থেকে ফিরে এসে আর্কের নাম পরিবর্তন করে সমস্ত লাইনআপটা নিয়ে ২০০২ সালে নতুন আর একটি ব্যান্ড করলেন "স্বাধীনতা" । স্বাধীনতার ব্যানারে প্রথম এ্যালবাম হচ্ছে ‘কারবালা’।

ছোট বেলা থেকেই হাসান হামদ, নাত ও কবিতা আবৃত্তিতে পারদর্শী ছিলেন। কবিতা লেখার অভ্যাসও ছিল কিছুটা। শিশু কবি হিসাবে তার বেশ পরিচিতি ছিল। অভিনয়েও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীতে তিনি অভিনয়, স্বরচিত কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। পারিবারিক অনুমতি না থাকায় তিনি এগুলো একরকম লুকিয়ে লুকিয়েই করতেন।

এই ধরনের কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র তার স্কুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাইরের অন্য কোন সংগঠনের সাথে তার জড়িত হবার সুযোগ ছিল না। এমনকি গান শোনা, কবিতার বই পড়া বা সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রেও ছিল প্রতিবন্ধকতা। বড় বোন হুসনা আফরোজ রেডিও ও টিভিতে নাটক করতেন। শুটিং এ যাবার সময় মাঝে মধ্যে ছোট ভাই হাসানকে সঙ্গে নিতেন। মূলত সেখান থেকেই তিনি সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি নিজে গান লিখে সুরারোপ করার চেষ্টা করতেন।

১৯৮৯-৯০ সালের দিকে তিনি ইংরেজি গানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। নিজেদের বাড়ীতে গান শোনা বা গাওয়ার সুযোগ না থাকায় স্কুলজীবনের শেষের দিকে বন্ধুদের বাসায় গিয়ে তিনি গান শুনতেন। প্রথম দিকে মাইকেল জ্যাকসন, জর্জ মাইকেল, স্কোরপিওন, মেইডেন প্রভৃতি শিল্পীদের গান শুনতেন। ১০ম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি কিছুটা হাইগ্রেড এর গান শোনা শুরু করলেন। এই সময় তার গানের প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্মায়।

১৯৮৯-৯০ সালের দিকে তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে পল্লীগীতির উপর একটি সার্র্টিফিকেট কোর্সে ভর্তি হন। শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ ও পল্লীগীতির সুর আয়ত্ব করতেই তার এই পল্লীগীতি কোর্সে ভর্তি হওয়া। ছোট বেলা থেকেই তিনি সুরের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ২০০১ সালে হাসান মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারে 'তাল' গানের জন্য শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন।

গানের শুরুতে কিন্তু হাসানের চুল কিন্তু এতো বড় ছিল না। আমি করি ১৯৯৩ সাল থেকে গান শুরুর পরে চুল বড় করেন '৯৬ সালের দিকে। তো এইটাতে কিন্তু আসলে অনেক কষ্ট আছে। কারণ লম্বা চুল রেখে তা সেপে রাখা ছিল অনেক কঠিন কাজ। এরজন্য প্রায় দেড় থেকে দুই বছর সময় লেগেছে। তখন ভাগ্যক্রমে তার বাবা আমেরিকায় ছিলেন, ঐ সময়টাকেই কাজে লাগান পুরোপুরি। যখন পরিচিতি পেয়ে যান চুল নিয়ে, তখন আর কেউ তেমন কিছু বলত না।

তাঁর গানগুলা সব নিজেত জীবনের গল্প থেকে করা মানে সত্য ঘটনা অবলম্বনে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েই এক একটা গান তৈরি। যেমন ‘সুইটি তুমি আর কেঁদো না’ গানের সুইটি অবশ্যই ছিল। এটা একটা চরিত্র। প্রতিটা পুরুষের মনেই একজন নারীর অস্তিত্ব থাকে, সেই হল সুইটি। তো আমার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তো সেই চরিত্র নিয়েই গানের সৃষ্টি হল সুইটি। আবার ‘একাকী’ গানটায় প্রিয়জনের কথা ভেবে ঘুম না আসা, কিছু অভিমানের কথা এই সব তো আমাদের জীবনেই আছে।

খ্যাতির বিড়ম্বনা বা মজার কোনো একটা ঘটনা আপনাদের বলছি। সে সময় দেখা যেত তাঁর চুল অনেকে ধরে দেখতে চাইতো, আবার বেশির ভাগ মেয়েরা এসে জিজ্ঞেস করতো কীভাবে চুলের যত্ন নেই, কি শ্যাম্পু ব্যবহার করেন? এক্ষেত্রে তার চুল ছিল আলোচিত একটা বিষয়। একবার তারা রাতে ব্যান্ডদল যাচ্ছিলেন ফরিদপুরের দিকে। রাতে ফেরিতে সবাই। তো তখন দেখলেন ১২টার দিকে একটা কেক আসলো লেখা ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু হাসান’।

তাঁর মাথায় কাজ করলো যে ১২ টা বেজে গেছে আর তারিখও ১৯ এপ্রিল। তার অজান্তেই এরকম ঘটনায় পুরো ফেরির লোক জড়ো হয়েছিল। তাঁর আরেকটা স্মৃতি রাজেন্দ্রপুর কলেজে একটা কনসার্টের মাঠে প্রায় ৩০ হাজার এর মতো দর্শক ছিল। রাতে গান করছিলাম। তো তারা ১২টার সময় দেখি চিৎকার করে বলছে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু হাসান’। তখন কেক কাটি। এ ঘটনাগুলো তার জন্য খুব আনন্দের একটা ব্যাপার। মানুষের ভালোবাসা এভাবে পাওয়া, এভাবে লাইভ কেক কাটা। এটা স্বরণীয় সময় আর কি।

হাসানের পরিবারে তাঁর মা বেঁচে আছেন। তাঁর আব্বা মারা গেছেন ২০০২ সালে। ৪ ভাই ৩ বোন। বলতে গেলে তিনি সবার ছোট। কিন্তু তাঁর একজন জমজ আছে যার নাম হুসেন। আর বিবাহিত জীবনে একটা ছেলে একটা মেয়ে আছে। ছেলের নাম হাসিন, মেয়ে নূরজাহান। ছেলে বড় হয়ে গেছে। তিনি কখনোই কোন বিষয়ে জোর করেন না বা চাপিয়ে দেন না তাঁকে ফলো করার জন্য মানে তার প্রফেশনে আসার জন্য। তিনি মনে করেন। ক্রিয়েটিভ মানুষ যারা তারা যেকোনো বিষয়কে মেলে ধরতে পারে। তো যার যেদিকে যেতে ইচ্ছা করে তাকে সেদিকেই যেতে দেয়া উচিৎ।
হাসানের গানের আইডল হচ্ছেন মাইকেল জ্যাকসন। মানুষের কণ্ঠ এতো মধুর হতে পারে বা এতো সুন্দর করে কীভাবে গায় এটাই তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। প্রিয় রঙ কালো আর নীল।স্যুপ খেতে তিনি ভীষণ পছন্দ করেন। তবে যত নরমাল হয়।
প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে চির ঋণী বলেন তার বড় বোনের প্রতি, মানে বুবু যাকে ডাকেন আর ভক্তির জায়গা থেকে তার বাবা।তিনি গীটার নিজে নিজেই আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন।

হাসান তার প্রথম ইনকাম প্রসঙ্গে বলেন যে, তিনি ৯৩ সালে ‘কপিয়ার’ বলে একটা অ্যালবাম করেছিলেন। ঐটাই কিন্তু প্রথমবার মাইক্রো ফোনের সামনে গান গেয়েছিলেন তিনি। তো যার জন্য একদম আনকোরা ছিলেন। গান যে গাইতে পারছিলেন এটাই অনেক বড় ব্যাপার তখন। ইনকামের ব্যাপারটি আরকি মাথায় আসেইনি। মানে তখন তেমন একটা অনুভুতিতেই ছিললেন। তখন আশিকুজ্জাম টুলু ভাইয়া বললেন তুমি কি চাও?

তখন একটা একোস্টিক গিটার হলেই তিনি খুশি। তো পরে তিনি তাকে একটা খাম ধরিয়ে দেন। তিঞ্জ ভেবেছিলাম ১৮০০টাকা হলে একটা গিটার হয়ে যাবে এমন কিছুই আছে। তো তিনি গুণে দেখলেন ৮০০০টাকা! তখন তিনক অবাক হয়ে গেলেন যে এই ভেবে যে তিনি কে? তিঞ্জ কি গাইলেন তার আবার পেমেন্ট, তাও কিনা চারগুণ! এই যে সারপ্রাইজটা এটা তার কাছে আসলে স্বপ্নের মতো ছিল। এরপর জীবনে অনেক পেয়েছেন। একটি সোলো অ্যালবামে সব্বোর্চ অ্যামাউন্ট যেটা বাংলাদেশের মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন তবে সেই অনুভুতিটার আগের মতো না।। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হাসান আর্কের একক এন্ড মিক্সড এ্যালবাম সমূহ……

বিশ্ব সঙ্গীত দিবসের শুভেচ্ছা বার্তা, (হাসান আর্ক)

কারবালা - হাসান (স্বাধীনতা ব্যান্ড) ২০০২